ভিডিও

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সচেতনতা 

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪, ০৭:০৩ বিকাল
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪, ০৭:২৮ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসটিকে বিশ্বব্যাপী পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা পিসিওস(PCOS) সচেতনতা মাস হিসেবে পালন করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই, এই সিনড্রোম সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা। বিশ্বজুড়ে বর্তমানে প্রায় আট থেকে দশ শতাংশ মেয়ে এই সিনড্রোমে ভুগছে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন এটি কতোটা সাধারণ। 

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে আসুন জেনে নিই, পিসিওস বা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম আসলে কি?
পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম মূলতঃ একটি কন্ডিশন যা ওভারী বা ডিম্বাশয়কে আক্রান্ত করে। এই কন্ডিশনে সাধারণের তুলনায় অনেক বেশী ডিম্বধারণকারী থলে থাকে যেগুলোকে আমরা ফলিকল বলি। এই ফলিকলগুলি নিয়মিত ডিম্বক নিঃসরণ করে না এবং এগুলো সাধারণের তুলনায় অধিক পরিমাণ টেস্টোস্টেরণ তৈরি করে। আর এসব কারণেই কতগুলো লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন-অনিয়মিত পিরিয়ড, শরীরে অবাঞ্ছিত লোম, ব্রণ, অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি, মাথার চুল পড়ে যাওয়া, সন্তান ধারণে অসুবিধা ইত্যাদি। আর ঠিক এগুলো থেকেই তৈরি হয় মানসিক অস্থিরতা, হতাশা ইত্যাদি। 

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম কি নিরাময়যোগ্য রোগ?
সবচেয়ে কমন এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এটি। যদি এক কথায় উত্তর দিই, তাহলে উত্তর হল, না। এটি পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য নয়। কিন্তু এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ধরুন, ডায়াবেটিস কিংবা থাইরয়েড ইত্যাদি সমস্যা হলে কি পুরোপুরি নিরাময় হয়? হয় না তো! কিন্তু আমরা জীবনব্যবস্থা পরিবর্তনের মাধ্যমে এবং প্রয়োজনে কিছু ওষুধের দ্বারা এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখি। একই বিষয় প্রযোজ্য, পিসিওস(PCOS) এর ক্ষেত্রেও। যেহেতু এটি একটি হরমোন রিলেটেড সমস্যা, এটিও পুরোপুরি নিরাময় হবে না। কিন্তু একটু সচেতন হলেই এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। 

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম কি ভয় পাওয়ার মত কোন সমস্যা? 
এটির উত্তরও ‘না’। এটি নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এটি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত সদিচ্ছা এবং সামাজিক সচেতনতা। এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত কোলেস্টেরল, হৃদরোগ, অতিরিক্ত রক্তস্রাব ইত্যাদি কিছু দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হতে পারে। কিন্তু আশার বিষয় হল, আমরা সবাই একটু সচেতন হলেই এ সবকিছুইকেই ‘না’ বলা সম্ভব। 

আমি প্রধান কয়েকটি বিষয়ে সচেতনতার কথা বলব আজ। 
প্রথমতঃ পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমে যে সমস্যাটি নিয়ে মেয়েরা উদ্বিগ্ন হয়, সেটি হল অনিয়মিত রক্তস্রাব। এটি একটি সাধারণ সমস্যা। কিন্তু আমাদের দেশের মেয়েরা এটি নিয়ে সবচেয়ে বেশী কনসার্ন থাকে। বিষয় হল, পিসিওসে নিয়মিত পিরিয়ড হবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে খুব দীর্ঘ সময় ধরে পিরিয়ড না হলে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। এই কারণে তিন মাসের অধিক সময় পিরিয়ড বন্ধ থাকলেই আমরা একজন গাইনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করব। এখানে একটি কথা বলে রাখা আবশ্যক, নিয়মিত পিরিয়ড হওয়া ভাল, কিন্তু পিসিওসে যেহেতু হরমোনের সমস্যা থাকে, কাজেই এদের বছরে বারোটি পিরিয়ড হবে না। এটা মেনে নিতে হবে। আটটি হতে পারে, ছয়টি হতে পারে। এ নিয়ে এত ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। জেনে রাখুন, পিসিওসের ক্ষেত্রে জরায়ুকে সুস্থ এবং সচল রাখার জন্য বছরে তিন থেকে চারটি পিরিয়ডই যথেষ্ট। খুব সাধারণভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের মাধ্যমে এটি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। প্রশ্ন আসে, অবিবাহিত অবস্থায় জন্মনিরোধক পিল খেলে কোন ক্ষতি হবে কি না?
এর উত্তরও ‘না’। জন্মনিরোধক পিলে থাকে দুটি বা একটি হরমোন। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমসহ আরো অনেকগুলো গাইনি রিলেটেড রোগে জন্মনিরোধক পিলকে আমরা ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করি। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এর কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। সেরকম কিছু হলে আপনার গাইনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিবেন। 
দ্বিতীয়তঃ যে বিষয়টি মেয়েদের উদ্বেগের কারণ, তা হল অতিরিক্ত স্থূলতা বা মোটা হয়ে যাওয়া। পিসিওসে হরমোনাল অসামঞ্জ্যসতার কারণে শরীর মুটিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এটি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রয়োজন জীবনযাত্রার কিছু পরিবর্তন, নিয়মিত হাঁটা বা ব্যায়াম করা এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা। প্রয়োজনে একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। 
তৃতীয়তঃ যে জিনিসটি নিয়ে মেয়েরা বেশ বিব্রত থাকে, সেটি হল শরীরে অবাঞ্ছিত লোম। ইতোপূর্বেই আমরা আলোচনা করেছি যে, এদের শরীরে সাধারণের তুলনায় বেশি টেস্টোস্টেরন বা পুরুষালি হরমোন নিঃসরণ হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, সব মেয়ের শরীরে অল্প পরিমাণে পুরুষ হরমোনের উপস্থিতি থাকে। এবং ভাইস ভার্সা। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমের ক্ষেত্রে এর মাত্রাটা বেশী থাকে। আর এই কারণেই শরীরে অতিরিক্ত লোম, ব্রণ, চুল পড়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণগুলো দেখা দেয়। এমনকি অনিয়মিত ঋতুস্রাব বা সন্তান ধারণের সমস্যাগুলোও এটির কারণে হয়ে থাকে। 
শরীরের অতিরিক্ত লোম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে আমাদের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সমস্যা বেশি প্রকট হলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা আবশ্যক। 
চতুর্থতঃ আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট দেখে অনেকেই ভীষণ ঘাবড়ে যান। পলিসিস্টিক লেখা দেখে ভেবে বসেন, ওভারিতে সিস্ট হয়েছে, সুতরাং এটা অপারেশান করতে হবে। এখানেও উত্তর হল, ‘না’। কোন অপারেশনের প্রয়োজন নেই। উপরের আলোচনায় আমরা বলেছি, এই কন্ডিশনে অধিক সংখ্যক ফলিকল তৈরি হয়, যেগুলো প্রয়োজনীয় মেয়েলী হরমোনযুক্ত পরিবেশের পরিবর্তে পুরুষালী হরমোনযুক্ত পরিবেশ থাকায় পুরোপুরি পরিপক্ক হতে পারে না। পরিপক্কতার বিভিন্ন পর্যায়ে এরা আটকে থাকে। ফলে ওভারীর চারপাশে এই ছোট ছোট ফলিকলগুলো সিস্টের আকারে মালার মতো সাজানো থাকে। এজন্যই এটাকে পলিসিস্টিক ওভারী বলা হয়। সিস্ট বলতে প্রচলিত ধারণায় আমরা যা বুঝি, এটা ঠিক সেটি নয়। কাজেই সনোগ্রাফিক রিপোর্ট দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। 
পঞ্চমতঃ পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হয়। ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে কালো ছোপ ছোপ দাগ দেখা দিতে পারে। এবং ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়। মূলতঃ স্থূলতার কারণেই ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধি পায়। সুতরাং,এটিকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজন ওজন নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ, জাঙ্কফুড এড়িয়ে চলা, নিয়মিত শরীরচর্চাসহ লাইফস্টাইল বা জীবনধারার পরিবর্তন। 
সর্বশেষ যে বিষয়টি নিয়ে সচেতন করতে চাই, সেটি হল, সন্তান ধারণে অসুবিধা। আমাদের দেশের একটি ট্যাবু হল, নিয়মিত পিরিয়ড না হলেই আমরা ধরে নিই যে, সে আর সন্তান ধারণ করতে পারবে না। এটি খুবই ভুল ধারণা। তার সন্তান ধারণে কিছু বিলম্ব হতে পারে, কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে। কিন্তু সন্তান ধারণ করা সম্ভব নয়, তা নয়। সন্তান ধারণে বিলম্ব হলে আপনার গাইনী বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। আশা করি, অল্প চিকিৎসাতেই ভালো ফলাফল পেয়ে যাবেন। 
পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম কোন একক রোগ নয়। হরমোনাল তারতম্যের কারণে সৃষ্ট কতগুলো উপসর্গের সমন্বয়ে সৃষ্ট একটি কন্ডিশন। পরিবেশগত এবং আমাদের সেডেনটারি লাইফস্টাইলের কারণে এর ব্যাপ্তি ক্রমাগত বাড়ছে। তাই শেষ কথা বলতে চাই, একদম ছোট থেকেই বাচ্চাদের খাবারের ব্যাপারে সচেতন হউন। তাদের হাঁটাহাঁটি, খেলাধূলা, ব্যায়াম ইত্যাদিতে উৎসাহিত করুন।যদিও পিসিওসের ব্যাপারে কিছু জিনগত সমস্যা রয়েছে, কাজেই এটিকে সরাসরি প্রতিরোধ করতে না পারলে লাইফস্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে এর জটিলতাগুলোকে আমরা প্রতিহত করতে পারি খুব সহজেই। 

ডা. ফাহমিদা শিরীন নীলা
এমবিবিএস ; এফসিপিএস(গাইনী); ফিগো ফেলো(ইটালী)
গাইনী কনসালট্যান্ট।

 



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS